টনসিল হলে করণীয় কি। টনসিল অপারেশন রোগীর খাবার তালিকা
টনসিল কি টনসিল কেন হয় টনসিল হলে করণীয় কি এবং সেইসাথে টনসিলের চিকিৎসা, টনসিল অপারেশন পরবর্তী খাবার তালিকা, কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে অর্থাৎ টনসিল সম্পর্কিত সকল বিষয় আজকের আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছে।
টনসিল কি?
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করার জন্য যে ইমিউন সিস্টেম কাজ করে সেই ইমিউনিটি সিস্টেমের অন্তর্ভূক্ত লিম্ফয়েড এর একটি অংশ টনসিল। যেটি আমাদের গলার চারপাশে থাকে। মেডিকেলে ভাষায় একে ওয়ালডায়ারস রিং বলা হয়। আর এই টনসিলে যখন ইনফেকশন হয় তখন একে টনসিলাইটিস (tonsillitis) বলা হয়।
টনসিলাইটিস কেন হয়?
সাধারনত ইনফেকশনের কারনে টনসিলাইটিস হয়। প্রধান কারন হচ্ছে ভাইরাল ইনফেকশন। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের কারনেও টনসিলাইটিস হতে পারে।
টনসিল কি আপনা-আপনি সেরে যায়?
হ্যাঁ। টনসিলাইটিস আপনা-আপনি সেরে যেতে পারে। ভাইরাল ইনফেকশন হলে ৮-১০ দিন বা ক্ষেত্রবিশেষে ১০-১৪ দিন সময় লাগতে পারে।
টনসিলে ইনফেকশন হলে কি কি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে?
- খুব ঠান্ডা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
- অতিরিক্ত ঝাল ও মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন।
- প্যাকেটজাত খাবার যেমন, চিপস, সিঙ্গারা প্রভৃতি এড়িয়ে চলুন।
টনসিলে চিকিৎসায় কখন অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে?
যদি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয় তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যদি মনে করেন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া প্রয়োজন তাহলে সেক্ষেত্রে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবেন না।
চিকিৎসার মাধ্যমে টনসিলের সমস্যা কি চিরতরে দূর হবে?
না। চিকিৎসার মাধ্যমে টনসিলের সমস্যা চিরতরে দূর হবে না। চিকিৎসা করলে টনসিলে যে ইনফেকশন হয়েছে তা সাময়িকভাবে দূর হয়ে যাবে। টনসিল যেটি প্রাকৃতিক বিষয় যেটি আমাদের প্রত্যেকের গলায় থাকে সেটি থেকেই যাবে।
টনসিলাইটিস এ যদি চিকিৎসা না করাই কিংবা অসম্পূর্ণ চিকিৎসা করাই তাহলে কি হবে?
যদি টনসিলের অসম্পূর্ণ চিকিৎসা করাই কিংবা একেবারে চিকিৎসা না করাই, টনসিলে যদি ভাইরাল ইনফেকশন হয় তাহলে ৪-১০ দিনের মধ্যে সেরে যাবে। টনসিলে যদি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয় সেক্ষেত্রে ইনফেকশনের মাত্রা বা তীব্রতা অনুযায়ী কখনো কখনো এই টনসিলের চারপাশে ইনফেকশন ছড়িয়ে গিয়ে সেখানে পুঁজ হতে পারে। এই পুঁজ দুই ফুসফুসের মধ্যবর্তী অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। এবং এটি খুবই বিপদজনক হতে পারে।
যদি টনসিলাইটিস হয় তাহলে বাসায় কি করবেন?
বাসায় প্রাথমিকভাবে কিছু ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারি।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
- উষ্ণ তরল খাবার চা, স্যুপ খান।
- যদি ব্যথার মাত্রা বেশি থাকে তাহলে ঠান্ডা খাবার এমনকি বরফও খেতে পারেন।
- এরপরও ব্যথা না সারলে কুসুম গরম পানি দিয়ে গার্গেল করতে পারি। এতে ব্যথা উপশম হতে পারে।
- বাসার রুমের তাপমাত্রা যদি নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয় তাহলে একটু আরামদায়ক করে নিতে পারেন। প্রয়োজনে রুম হিটার ব্যবহার করতে পারেন। এতে একটু ভালো লাগতে পারে।
- ব্যথার মাত্রা খুব বেশি হলে ওটিসি (OTC) ড্রাগ যেমন: নেপ্রোক্সেন এজাতীয় ওষুধ সেবন করতে পারেন।
- এ সময়টাতে খুব জোরে কথা বলা পরিহার করাই শ্রেয়।
- মুড়ি, খই ও কাঁটাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় ডান পাশে ঘুমালে কি হয়
টনসিল হলে কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
যদি টনসিলের ইনফেকশনের সমস্যা এবং গলা ব্যথা দুই দিনের বেশি থাকলে। অথবা অত্যাধিক গলা ব্যথার কারনে খাবার খেতে কষ্ট হয়, ঘুম আসতে কষ্ট হয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, গলা ব্যথার সাথে যদি জ্বর থাকে তাহলে নিকটস্থ নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করুন।
টনসিল অপারেশনের ন্যূনতম বয়স কত?
প্রযুক্তিগত কারনে টনসিলের অপারেশন খুবই ছোট একটি অপারেশন। এটি নিয়ে ভীত হওয়ার কিছু নাই। ওষুধ খাওয়ার পরে যদি কোন রোগী ভালো থাকে সেক্ষেত্রে অপারেশন প্রয়োজন নেই। টনসিল একটি লিম্ফয়েড অর্গান বা লসিকাগ্রন্থি যা বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় অংশগ্রহন করে এজন্য বাচ্চার টনসিল হলে তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগে অপারেশন না করে চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়ের চেষ্টা করা উচিত।
আরও পড়ুন: অ্যাজমার ঘরোয়া চিকিৎসা
টনসিল হলে কি অপারেশন করতেই হবে?
না। টনসিল হলে অপারেশন করাটা সবসময় জরুরী না। ক্ষেত্রবিশেষে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যখন মনে করবে আপনার টনসিলের অপারেশন করা জরুরী তখনই এটা এটা প্রয়োজন হবে। AMERICAN ACADEMY OF OTOLARYNGOLOGY — HEAD AND NECK SURGERY এর টনসিল অপারেশনের গাইডলাইন হলো খুব ঘনঘন টনসিল ইনফেকশন হলে ,ছয়মাসে ৩-৪ বার অথবা বছরে ৫-৬ বার অথবা পর পর দুবছর ৫ বার করে টনসিলে ইনফেকশন অথবা পরপর তিনবছর প্রতিবছর ৩ বার করে হলে। বছরের মধ্যে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১৪ দিন স্কুল এবং বড়দের ক্ষেত্রে অফিস বন্ধ রাখতে হয় তাহলে ডাক্তররা অপারেশনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। খুব বড় মাত্রায় টনসিল হলে যদি কথা বলতে কষ্ট হয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয় অথবা খাবার গিলতে কষ্ট হয় এরকম ক্ষেত্রে টনসিল অপারেশন করে ফেলা ভালো। অথবা কারো কারো ক্ষেত্রে ডাক্তার যদি মনে করে এই টনসিলে ক্যান্সারের ঝঁকি আছে সে ক্ষেত্রে টনসিলের অপারেশন করে ফেলাটা ভালো।
আরও পড়ুন: নবজাতকের শ্বাসকষ্টের লক্ষন কি কি এবং নবজাতকের শ্বাসকষ্ট কেন হয়
টনসিল অপারেশনের পর কি কি বিষয় এড়িয়ে চলতে হবে?
- টনসিল অপারেশনের পর এন্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেতে হবে। এন্টিবায়োটিক সাত থেকে দশদিন খেতে হয়। আপনাকে অবশ্যই এন্টিবায়োটিকের ডোজ সম্পূর্ণ করতে হবে। সেই সাথে সকালে ও রাতে অথবা শুধু রাতে প্রতিবার অন্যান্য ওষুধ সেবনের পূর্বে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেতে হবে।
- টনসিল অপারেশনের পর গলায় ব্যথা হবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। এই ব্যথা গলা থেকে কানে যেতে পারে। আপনাকে ব্যথার ওষুধ খেতে হবে। ব্যথার ওষুধ দিনে দুবেলা। ব্যথার তীব্রতা বেশি হলে দিনে তিনবেলা খাওয়া যেতে পারে।
- টনসিল অপারেশনের পর মুখ ও গলা পরিষ্কার রাখতে হবে। এ জন্য নিয়মিত দুবেলা দাঁত ব্রাশ করতে হবে। ছোট বাচ্চাদের ব্রাশ করার সময় সহযোগিতা করতে হবে। তবে সাবধান! ব্রাশের আগা অপারেশনের জায়গায় যেন আঘাত না করে। গলা পরিষ্কার করার জন্য মাউথওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। দিনে ৪-৬ বার মাউথওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। প্রতিবার খাবার পরে মাউথওয়াশ দিয়ে গলা পরিষ্কার করতে হবে।
টনসিল অপারেশনের পর কি কি খাবার খাওয়া যাবে না?
টনসিল খুবই সাধারন একটি অপারেশন। টনসিল অপারেশনের পর যেসব খাবার খাওয়া যাবে না
- টনসিল অপারেশনের পর শক্ত খাবার যেমন, খই, মুড়ি,টোস্ট,বিস্কুট প্রভৃতি শক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। এসব খাবার কারনে টনসিলের অপারেশনের জায়গায় আঘাত লেগে রক্ত বেরিয়ে যেতে পারে।
- টনসিল অপারেশনের পর গরম খাবার গরম চা, গরম দুধ, গরম কফি, গরম ভাত, গরম স্যুপ এগুলো খাওয়া যাবে না। এই গরম খাবারগুলো ঠান্ডা করে খান।
- ঝাল, মসলা ও এসিডযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। টনসিল অপারেশনের পর সেখানে কোন পর্দা বা আবরন থাকে না। সেজন্য এসব খাবার খেলে সেখানে ঝাল ধরতে পারে বা ব্যথা হতে পারে।
- কাঁটা যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। টনসিলের অপারেশন করা জায়গায় কাঁটা লেগে রক্ত ঝরতে পারে। সেই সাথে ব্যথা। তাই বলে মাছ খেতে কোনো বাঁধা নেই। তবে সাবধানে।
টনসিল অপারেশনের পর পুনরায় কখন জরুরী ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
টনসিলে যদি ব্যথা বন্ধ না হয়, ফুলে যায়, কিংবা রক্ত আসে সেক্ষেত্রে অবশ্যই জরুরী ভিত্তিতে পুনরায় যে ডাক্তার আপনার অপারেশন করেছেন তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে হবে।