কাঁচা রসুন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
রসুন প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যায়োটিক হিসেবে কাজ করে। নিয়মিত রসুন খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। কোলেস্টেরল কমে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া সহ মানব শরীরে নানাবিধ উপকার করে। বর্তমান সময়ের পুষ্টিবিদ এবং স্বাস্থ্যবিদরা রসুনকে নিয়ে বহুবিধ গবেষণা চালিয়ে এর উপকারিতা সম্পর্কে জনতে পেরেছেন। এ জন্য রসুনকে “ওয়ান্ডার ড্রাগ” বলা হয়ে থাকে।
রসুন সাধারনত রান্নায় স্বাদ বৃদ্ধির জন্য মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রাচীনকালের ইতিহাস গবেষণায় জানা যায়, চৈনিক, গ্রিস ও মিশরীয় সভ্যতায় রসুনকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রসুনে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন বি১ ও বি৬, ভিটামিন সি, সেলেনিয়াম, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ক্যালরি, থায়ামিন, নায়াসিন, সেলেনিয়াম ও প্যান্টোথেনিক এসিড। এসব পুষ্টিগুনের কারনে রসুনের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে।
কাঁচা রসুন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ
রসুন অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিফাংগাল ও অ্যান্টিভাইরাল হিসেবে কাজ করে। রসুনে রয়েছে অ্যালিসিন নামক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। রসুনকে বলা হয় প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক। এর প্রতিরোধী ক্ষমতা বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
রক্তচাপ কমায়ঃ
কাঁচা রসুন খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করা যায়। কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে ১-২ ঘন্টার মধ্যে তা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে কার্যকারিতা তৈরি করে। চায়ের সাথে মধু মিশিয়ে রসুন দিয়ে খেলে উচ্চ রক্তচাপ কিছুটা নিয়ন্ত্রনে থাকে।
- রসুনে সালফার রয়েছে। সালফার নাইট্রিক অক্সাইড উৎপন্ন করে। ফলে রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্তচাপ কমে যায়।
- রসুনে আছে অ্যালিলিন রিঅ্যাকটিভ যৌগ। ফলে উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীরা নিয়মিত ২ কোয়া কাঁচা রসুন খেলে অনেক সুফল পান।
রসুন কোলেস্টেরল কমায়ঃ
কোলেস্টেরল এক ধরনের চর্বি জাতীয় স্টেরয়েড। যা সেল মেমব্রেন এ পাওয়া যায় এবং রক্তে প্রবাহিত হয়। আমাদের দেহে প্রধানত দুই ধরনের কোলেস্টেরল পাওয়া যায়-
- (১) উচ্চ ঘনত্ত্বের লিপোপ্রোটিন (HDL)
- (2) নিম্ন ঘনত্ত্বের লিপোপ্রোটিন (LDL)
এই নিম্ন ঘনত্ত্বের লিপোপ্রোটিন (LDL) হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। কোলেস্টেরল রক্তনালীতে চর্বি জমা করে ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত করে। এক্ষেত্রে রসুন কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমায়। ফলে ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়ঃ
শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হলো হৃৎপিণ্ড। নিয়মিত ২ কোয়া কাঁচা রসুন খেলে হার্ট সচল থাকে। রসুনে অ্যালিসিন আছে। এই অ্যালিসিন হৃদযন্ত্রকে ভালো রাখে।
রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতা বাড়ায়ঃ
অফিসে দীর্ঘ সময় বসে থাকা কিংবা মসজিদে নামায পড়তে গেলে অনেকক্ষন পরে হাটাচলা করতে অসুবিধা হয়। পা সাময়িক অসাড় হয়ে আসে। কিংবা দীর্ঘ সময় পা ঝুলিয়ে রাখার ফলে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়। শরীরে অনেক সময় রক্ত সঞ্চালন কমে যায় বলেই এ রকম বিপত্তি সৃষ্টি হয়। এ জন্য শরীরে রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখাটা জরুরী। রসুনে রয়েছে অ্যালিসিন যা মূলত সালফার যৌগ। এটি রক্তনালী শিথিল করে, টিস্যু রক্তপ্রবাহ ও নিম্ন রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। এ জন্য প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ২ কোয়া কাঁচা রসুন খেলে রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
পুরুষের যৌন ক্ষমতা বাড়ায়ঃ
রসুনে গুণের শেষ নেই। প্রাচীনকাল হতে পুরুষের যৌন ক্ষমতা বাড়াতে রসুন ব্যবহার হচ্ছে।
- ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (ED): রসুনে রয়েছে এস অ্যালিল সিস্টাইল (এসএসি) নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ইরেক্টাইল ডিসফাংশন সমস্যা নিরাময় করে।
- টেস্টোস্টেরন মাত্রা বাড়ায়ঃ সেক্সের জন্য টেস্টোস্টেরন হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই হরমোন কমে গেলে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়। রসুন টেস্টোস্টেরন বাড়াতে সাহায্য করে।
- শুক্রানুর সংখ্যা বৃদ্ধি করেঃ নিয়মিত কাঁচা রসুন খেলে শুক্রানুর সংখ্যা বাড়ে। শুক্রানুর গুনগত মান বাড়ে। এতে বীর্য ঘন হয়।
সংক্রমণ প্রতিরোধ করেঃ
রসুনে প্রচুর অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টিফাংগাল উপাদান রয়েছে। যার ফলে নিয়মিত রসুন খেলে শরীরে কোন জীবাণু সংক্রমণ হয় না। এছাড়া শরীরের বহিঃত্বকে কোন স্থানে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়। তাহলে আক্রান্ত স্থানে রসুনের তেল অথবা জেল ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়।
হাড় মজবুত করেঃ
রসুনকে বর্তমানে সুপার ফুড হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বর্তমানে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয় একটি সাধারন সমস্যা। রসুনে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ ও অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে যা হাড়কে মজবুত করে । হাড় ক্ষয় রোধ করে। কাঁচা রসুন নারীদেহে এস্ট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে হাড় মজবুত ও শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।
রসুন ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করেঃ
ফুসফুস মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। ফুসফুস ভালো রাখা সহ সর্দি-কাশি প্রতিরোধে রসুনের কার্যকারিতা রয়েছে। রসুনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামাটারী উপাদান। যা ফুসফুস ভালো রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আরো পড়ুন:
শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে কি কি খাবার খাওয়া উচিত।
রসুন ডিটক্স হিসেবে কাজ করেঃ
শরীরকে রোগমুক্ত ও সতেজ রাখতে রসুন ডিটক্স হিসেবে কাজ করে। রসুন লিভারের এনজাইমগুলোকে সক্রিয় করে। যার ফলে শরীর হতে বর্জ্য পদার্থ নিঃসরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এছাড়া রসুনে প্রচুর পরিমাণে সেলেনিয়াম রয়েছে। এই সেলেনিয়াম শরীর হতে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেয়। রসুনে থাকা শক্তিশালী ডিটক্স শরীরকে উজ্জীবিত করে। নিয়মিত রসুন খেলে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ফুসফুসের সংক্রমণ সহ নানাবিধ জটিল অসুখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
রসুন ক্যান্সার প্রতিরোধ করেঃ
রসুনে প্রচুর পরিমাণে সালফারে পূর্ন অ্যালিসিন ও ডায়াল্লিল ডিসালফাইড রয়েছে। এসব উপাদান ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রসুনের অ্যান্টি-মাইক্রোবায়াল বৈশিষ্ট্য ডিএনএ মেরামত ও কোষের মৃত্যু হ্রাস করে ক্যান্সার হতে রক্ষা করে। রসুন স্টমাক এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে।
ওজন কমাতে রসুনঃ
রসুনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফাইবার যা শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে দারুন উপকারী। রসুন খেলে শরীরে বিপাকীয় হার বেড়ে যায় ফলে বেশি মাত্রায় ক্যালরী ঝরে যায়। রসুনে ফ্যাট বার্নিং কম্পাউন্ড রয়েছে যা অতিরিক্ত চর্বি জমতে দেয় না। শরীর হতে টক্সিন এবং ক্ষতিকারক পদার্থ বের করে দেয়। পাশাপাশি হজম শক্তিকে ত্বরান্বিত করে যা ওজন কমাতে সহযোগিতা করে।
বিষন্নতা দূর করেঃ
রসুন মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। মানসিক চাপ কমায়। এটি হতাশার বিরুদ্ধে ভালো কাজ করে।
এছাড়া কাঁচা রসুনের আরো বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে-
- রসুন ত্বক ভালো রাখে।
- শরীরের অবাঞ্চিত ফোলা বা গোটা নিরাময় করে।
- দাঁতের ব্যথা বা বাতের ব্যথা নিরাময় করে।
- ত্বকের ব্রন দূর করে, তারুণ্য ধরে রাখে দীর্ঘদিন।
- অ্যাজমা, কফ, নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করে।
- অনিদ্রা সমস্যা দূর করে।
- মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
- বিষন্নতা দূর করে।
- কৃমি দূর করে।
কিভাবে খাব?
রসুনের উপকারিতা পাওয়ার জন্য সকালে খালি পেটে খাওয়া উচিৎ। বিষেশজ্ঞদের মতে, কাঁচা রসুনে যত উপকার পাওয়া যায়। প্রক্রিয়াকরণের পর অতটা থাকে না। রসুনে যে সালফার রয়েছে চিবিয়ে খেলে সেটার কাযক্ষমতা বৃ্দ্ধি পায়। ঝাঁঝালো গন্ধের কারনে কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেতে না পরলে মধু মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ভাজি ও ভর্তায় কাঁচা রসুন খাওয়া যা। একটানা ১২ সপ্তাহ কাঁচা রসুন খেলে সর্দি, কাশি ও ফ্লু প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। রসুন ভাজলে বা রান্না করলে তাপে এটির প্রধান রাসায়নিক উপাদান অ্যালিসিন নষ্ট হয়। তাই কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে সর্বোত্তম উপকারিতা পাওয়া যায়।
সাবধানতা/ অপকারিতাঃ
- অনেকেরই রসুনে অ্যালার্জি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে রসুন না খাওয়াই ভালো।
- গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী মায়েদের কাঁচা রসুন এড়িয়ে চলা উচিৎ।
- অতিরিক্ত রসুন খাওয়ার ফলে ডায়ারিয়া হতে পারে।
- রসুনের সালফারের কারনে মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে।
আশা করি এই আর্টিকেলে কাঁচা রসুন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আপনার জানতে পেরেছেন।